দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ ১ম বিশ্বযুদ্ধ (২য় পর্ব)

১ম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৪।

যুদ্ধ সম্পর্কে জার্মানদের উৎসাহ তখন তুঙ্গে। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এমন সুযোগ তাদের কাছে অনেক বছর হল আসেনি। প্রতিটি দেশপ্রেমিক জার্মানের বিশ্বাস, এই মহাযুদ্ধ পুরা বিশ্বের মানচিত্রকে আমূল পালটে দিবে। যুদ্ধে তারা জয়লাভ করবেই। তাদের প্রধান শত্রু হল, মহাশক্তিধর ব্রিটেন, ফ্রান্স আর নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা রাশিয়া। এদের সাথে তাদের পুঁচকে সাগরেদ রাষ্ট্রগুলও যোগ দিয়েছে। তাতে কি। জার্মানরা আর এদের ভয় পায় না। পৃথিবীতে জার্মান সাম্রাজ্যের পতাকা এই উঠল বলে।

সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যের অভাব পরে না। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছে যুদ্ধে যোগ দিতে।



এই মহাযুদ্ধে সর্বপ্রথম আক্রমণে যায় জার্মানি। জার্মান আর্মি যেদিন প্রথম নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে তখন তারা এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে পায়। তাদের যাওয়ার পথ লোকে লোকারণ্য। প্রত্যেকে বিদায় জানাতে এসেছে। কেউ কাউকে চিনে না অবশ্য। কিন্তু হৃদয়ে ভালোবাসার পরিমাণ কারো কম নয়। এরূপ সমর্থন যুদ্ধগামী কোন সেনাবাহিনী খুব কমই দেখেছে। বিদায়বেলায় জনগণের এরকম উৎসাহ দেখতে পেয়ে সৈন্যরা অনুপ্রাণিত হয়।

যুদ্ধের শুরুর দিকে এই সৈন্যরা ছিল অপ্রতিরোধ্য। স্থলে জলে অন্তরীক্ষে দুনিয়ার তাবৎ সেনাবাহিনী তাদের কাছে পদানত।

অগাস্ট ৩, ১৯১৪।

১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ৫ দিন পর।

জার্মানির বাভারিয়ান রেজিমেন্টে স্বেচ্ছাসেবক সৈন্য হিসেবে যোগদান করতে একজন আবেদন করেছে। নাম অ্যাডল্‌ফ্‌ হিটলার। বয়স ২১। জাতিতে অষ্ট্রিয়ান। রিক্রুটমেন্ট অফিসার একজন দিল খোলা মানুষ। জার্মান সেনাবাহিনীতে অষ্ট্রিয়ানদেরও নিচ্ছেন। যুদ্ধের সময় এত কিছু দেখার সময় কই? আর তিনি জানেন যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারলে, জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগদানকারী এসব অষ্ট্রিয়ানদের অনেকেই জার্মান নাগরিকত্ব পাবে। হাজার হোক এই দুই জাতি পরস্পরের মিত্র। আর বাভারিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায়, এখানে অষ্ট্রিয়ানরাও নিজেদের জার্মান হিসেবেই ভাবে।


এসব কারণে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে হিটলারের বিশেষ বেগ পেতে হল না। অথচ এই পর্যায়ে আসতে তাকে কতই না কষ্ট করতে হয়েছিল। ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। নিজ গ্রামের বাড়ি লিঞ্জে কি সুখের সময়ই না কাটিয়েছিলেন। পরে ১৯০৯ সালে যখন মা মারা যান তখন তার জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ। মায়ের মৃত্যুতে মারাত্মক মানসিক আঘাত পান তিনি। তার চিত্রশিল্পী হবার স্বপ্ন মাঠে মারা যায়।


১৯০৯ সালে আয় রোজগার করবার আশায় ভিয়েনাতে পাড়ি জমান তিনি। কিন্তু তার কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। আবার পড়াশুনা শুরু করার কোন চেষ্টাই তিনি করেননি। বরঞ্ছ কোন রকমে দিনমজুরী করে দিন কাটাতে লাগলেন।


দিনমজুরীর পাশাপাশি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং তাদের মতাদর্শ সম্পর্কে তিনি বাস্তব জ্ঞান লাভ করা শুরু করেন। অবসর সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সভায় উপস্থিত থাকতেন এবং তাদের বক্তব্য মন দিয়ে শুনতেন। ধীরে ধীরে ন্যাশনাল সোশালিস্‌ম এর প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কোনটিই জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সাধন করতে পারবে না। উন্নতির জন্যে এমন একজন সৎ, দৃঢ় ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি শক্ত হাতে দেশের হাল ধরবেন। দেশের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে দ্রুত এর সমাধান করবেন। জনগণের উচিত সুখেদুঃখে তাকে সাহায্য করা, অনুসরণ করা এবং তার কাজে কোন বাধা না দেওয়া।


সেই সময় ইউরোপে বিভিন্ন দেশে ইহুদিদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ইহুদিরা বহু শতাব্দী আগে মুসলমানদের দ্বারা আরব দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। ইহুদীদের স্বধর্মবোধ ছিল প্রবল। নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যে তারা জীবন দিতে রাজি। এতে অন্যের ক্ষতিসাধন করতে তারা কখনো দ্বিধাবোধ করত না। এসব কারণে ইহুদীরা ইউরোপের অধিকাংশ মানুষের বিরাগভাজন ছিল।


ভিয়েনার এই একাকি জীবনে হিটলারের একমাত্র সঙ্গি ছিল বই। ইহুদীদের কুকর্মের কথা তিনি কিছু কিছু জানতেন। এই কারণে ইহুদী বিরোধী(anti Semitic) যত বই আছে সব তিনি পড়া শুরু করেন। যতই তিনি পড়তে থাকেন ততই তিনি অবাক হন। তিনি উপলদ্ধি করেন, এসব কীটগুলো সমাজের একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করছে। তাদের দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই। আছে স্বজাতিপ্রেম। নিজেদের চামড়া বাঁচাতে দেশকে বিক্রি করতে তারা দ্বিধাবোধ করবে না।


হিটলার তার আত্মজীবনী mein kampf এ লিখেন, "এর কিছুদিন পর আমি শহরে বেরিয়ে পড়ি, ইহুদীদের খোজে। আমি লজ্জিত বোধ করছিলাম এই ভেবে যে এতটা বছর শহরে বসবাস করেও এদের খোজ আমি পাইনি। হঠাৎ করে এক লোককে দেখে আমি থমকে দাড়াই। তার বড় কাফতান, মুখে বড় দাড়ি, মাথায় ছোট টুপি দেখে আমার আর কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু, ''সে কি ইহুদী? বিশ্বাসঘাতক?" এই প্রশ্ন আমার মনে জাগে না। যতই আমি ওই লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ততই আমার মনে এই প্রশ্ন দৃঢ়মূল হয়, "এই লোক কি আসলেই জার্মান হওয়ার যোগ্যতা রাখে?"।"


তিনি আরও লিখেন, "ইহুদীদের প্রতি আমার ঘৃণা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। একজন জার্মান হিসেবে আমি তাদের আর মোটেই সহ্য করতে পারছিনা।"
ইহুদীদের প্রতি এই ঘৃণাবোধ হিটলারের আমৃত্যু ছিল। জীবনের শেষ দিনে, আত্মহত্যা করার ২ ঘণ্টা আগে তিনি যে টেস্টামেন্ট রেখে যান সেখানে ইহুদীদের প্রতি চরম বিশদ্গার করা হয়। যুদ্ধের জন্যে তিনি তাদের দায়ী করেন। এই পৃথিবীতে যতদিন এই বিশ্বাসঘাতক জাতিটি টিকে থাকবে ততদিন পর্যন্ত বিশ্বশান্তি সম্ভব হবে না বলে ভবিষৎবাণী করেন।


১৯১৪ সালে হিটলার বাভারিয়ান রেজিমেন্টে একজন "ডিসপ্যাচ রানার" হিসেবে যোগ দেন। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খবর পৌঁছে দেওয়া ছিল এদের কাজ। অপরিসীম সাহস আর দ্রুত চিন্তা করার ক্ষমতা তার ছিল। নিজ যোগ্যতা বলে তিনি কর্পোরাল পদে উন্নীত হন।


কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মাত্রাতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে তিনি স্বল্প সময়ে বিখ্যাত দুটি মেডাল বাগিয়ে নেন। প্রথমটি হল "দ্য আয়রন ক্রসঃ সেকেন্ড ক্লাস।" শত্রুর তীব্র মেশিনগান ফাইয়ারের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। এটি পেয়েছিলেন যুদ্ধের একেবারে শুরুতে ১৯১৪ সালে।


অপরটি হল "দ্য আয়রন ক্রসঃ ফার্স্ট ক্লাস"। হিটলার ধোঁকা দিয়ে ১৫ জন ফরাশি(মতান্তরে ব্রিটিশ) সৈন্যকে একটি বাঙ্কারের মধ্যে নিয়ে আসেন। হিটলার একা ছিলেন। তিনি জানতেন ফরাসিরা তা বুঝতে পারলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। এই কারণে বাঙ্কারের বাইরে থেকে মারাত্মক চেঁচামেচি শুরু করে দেন, আর উচ্চস্বরে তাদের সারেন্ডার করতে আদেশ দিতে থাকেন। ফরাসিরা মনে করেছিল যে তারা বিপুল সংখ্যক জার্মান সৈন্য দ্বারা ঘেরাও হয়েছে। এই কারণে তারা আত্মসমর্পণ করে।


বিপদের সময় এরূপ অসাধারণ বীরত্ব দেখানোর কারণে হিটলারকে "দ্য আয়রন ক্রসঃ ফার্স্ট ক্লাস" দেওয়া হয়। এটি এমন এক সম্মান যা উচ্চপদের সৈন্যরাও সহজে পেত না। হিটলার আজীবন এই মেডেল পড়ে থাকতেন।