দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ হিটলারের শৈশবকাল

১৯১৮, ১০ নভেম্বর, সন্ধ্যা,


১ম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিন।


পাসওয়াক হাসপাতাল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কিছুটা দূরে বলে তা শত্রুর আর্টিলারির আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। চারদিকে আহত সৈনিকের আর্তনাদ। কিন্তু এরই মাঝে একটি খবর হাসপাতালের পরিবেশকে আরও গুমট করে দেয়। এক সৈনিক থেকে আরেক সৈনিক, এভাবে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পরে সেই খবর। হাসপাতালের বৃদ্ধ পুরোহিত, খবরটি শুনতে পায়। তার আর তর সয় না।
তিনি ছুটে যান এক বিশেষ রোগীর কাছে। এক মাস আগে শত্রুর বিষাক্ত গ্যাস বোমার আক্রমণে ওই রোগী গুরুতর আহত হন। কেমিক্যাল গ্যাসের আক্রমণে তার অধিকাংশ সহযোদ্ধার ফুসফুস জ্বলে গেলেও তিনি অলৌকিকভাবে রক্ষা পান এবং তাকে দ্রুত নিয়ে আসা হয় এই হাসপাতালে। ইতিমধ্যে নিজের বাগ্মিতার কারণে হাসপাতালে অন্যান্য রোগী আর কর্মচারীদের মাঝে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছেন। বৃদ্ধ পুরোহিত এসে তাকে বললেন, "সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে হের্‌ অ্যাডল্‌ফ। জার্মানি যুদ্ধে হেরে গিয়েছে।"


পুরোহিতের কথা তার বুকে শেলের মত বিঁধে। তিনি বিশ্বাসই করতে পারলেন না। নিজের দেশের এরুপ পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বালিশের মধ্যে মুখ গুজে তিনি ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। পুরোহিত তাকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, "পরদিন যুদ্ধবিরতি হবে, কাইজারকে সিংহাসন ছাড়তে হবে। আগামিকাল থেকে জার্মানি হবে প্রজাতান্ত্রিক।" এই কথা শুনে অ্যাডল্‌ফ আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। কয়েক বছর পর তার নিজের আত্মজীবনীতে ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লেখেন, "গভীর হতাশার সাথে এই সংবাদ শুনে আমি ওয়ার্ডে ফিরে আসি এবং কম্বল ও বালিশ এর নিচে আমার ব্যথা চাপা দেই।"


পাসওয়াক হাসপাতালে সেদিন যে ব্যাক্তি ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলেন, তিনি আর কেউ নন। স্বয়ং অ্যাডল্‌ফ হিটলার।


বর্তমান যুগে হিটলার শব্দটাই চমক জাগানিয়া। সবাই তার সম্পর্কে জানতে চান। হিটলার দুটো কথা প্রায়ই বলতেন, "history is written by the victors." এবং "The victor will never be asked if he told the truth." দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে যায়। স্বভাবতই যুদ্ধের সমগ্র ইতিহাস লেখার দায়িত্ব বিজয়ী মিত্রশক্তি নিজেদের হাতে তুলে নেয়। আর নিজেদের মহত্ত্বকে প্রকাশ করার জন্যেই হোক অথবা সত্য ঘটনা উদ্ধার করেই হোক বিভিন্ন ভাবে তারা হিটলারের চরিত্রকে তুলে ধরেন। যুদ্ধের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু যুদ্ধের জন্যে একা হিটলারকে দায়ী করাটা ঠিক না। আর এখানেই হিটলারের উক্তি দুটির সফলতা।


হিটলার ছিলেন গরীবের সন্তান। জার্মানির জন্যে জীবন উৎসর্গ করলেও তিনি জাতিগতভাবে জার্মান ছিলেন না। তার জন্ম austriaতে। ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল, german-austria সীমান্ত, যা বাভারিয়ান সীমান্ত নামে পরিচিত, তার austria অংশে সন্ধ্যা ৬ টায় তিনি জন্ম লাভ করেন। তার এক ভাই, এক বোন ছিল। ১৪ বছর বয়সে তার পরিবার austriaর ল্যাম্বাস শহরে স্থানান্তরিত হয়। তাকে গির্জার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।


সেখানে একটি জিনিস তাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। তা হল গির্জার মধ্যে সাজানো কাষ্ঠনির্মিত কতগুলো স্বস্তিকা। জার্মান সভ্যতায় স্বস্তিকা(swastika) চিহ্ন হল সমৃদ্ধি এবং কল্যাণের প্রতীক। ভবিষ্যৎে স্বস্তিকাই হয় নাৎসিদের প্রতীক। ১৯৩৩ সালের ১২ মার্চ জার্মানির প্রচলিত জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করে পার্লামেন্ট বিল্ডিং এর শীর্ষে স্বস্তিকা সংবলিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর পটভূমিতে ছিল লাল ও সাদা। হিটলার নিজে পতাকাটির নকশা করেছিলেন। পতাকার লাল রঙকে তিনি দেখতেন জার্মানির জাতীয়তাবাদী আদর্শ এবং সাদা অংশকে দেখতেন আর্য জাতির বিজয় বা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে।


হিটলারের শৈশব কাটে জার্মান সীমান্তের কাছাকাছি austriaর ভূখণ্ডে। এখানকার মানুষরা নিজেদের austrio-german বলে ডাকত। austrian হাম্পস্‌বার্গের প্রজা হওয়া সত্ত্বেও জার্মান কাইজারকে তারা রাজা মানত। হিটলার ও তার বন্ধুরা austrian রাজতন্ত্রকে অভিবাদন না করে "heil"(দীর্ঘজীবী হোক) বলে জার্মানিকে অভিবাদন করত। হিটলারের স্কুলে ইতিহাসের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি বিসমার্ক এবং ফ্রেদেরিক দ্য গ্রেট এর মত জার্মান বীরদের গুণকীর্তন করতেন। তাদের কথা শুনে হিটলারের মনে আবেগের জোয়ার বয়ে যেত। এভাবে তার কিশোর মনে জার্মান জাতীয়তাবাদের বীজ উপ্ত হয়।


জার্মান লেখক কার্ল মে ছিলেন তার প্রিয় লেখক। লেখক কার্ল মে দক্ষিণ আমেরিকার একজন বীর যোদ্ধাকে নিয়ে অনেক বই লিখেছিলেন। এই বীর যোদ্ধার নাম হল ওল্ড শ্যাটারহ্যান্ড। বীর শ্যাটারহ্যান্ড রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন। সাহস আর ইচ্ছাশক্তিই ছিল শ্যাটারহ্যান্ডের বিজয়ের মূলমন্ত্র। হিটলার আজীবন এই সিরিজের বই সঙ্গে রেখেছিলেন এবং নিজ জেনারেলদের রাশিয়া অভিযানকালে এই বইগুলো সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেন।


এরই মাঝে চিত্রাঙ্কনের প্রতি তার প্রবল ঝোঁক তৈরি হয়। তিনি সামনে যা পেতেন হুবুহু এঁকে ফেলতে পারতেন। পিতার কাছে তিনি চিত্রকর হবার বায়না ধরেন। কিন্তু হিটলার এর পিতা চেয়েছিলেন তার পুত্র তার মত সরকারি চাকুরীজীবী হবে। এই কারনে তিনি সাফ মানা করে দেন। পরে পিতার ইচ্ছাই জয়জুক্ত হয়। বহু বছর পর হিটলার স্বীকার করেছিলেন যে সেদিন পিতা যদি তাকে বাধা না দিতেন, তবে তিনি নিজেকে চিত্রকর হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতেন।


কিন্তু এরই মাঝে হিটলারের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। ১৯০৩ সালে তার বাবা মারা যান। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব তার কাঁধে চাপে।


চিত্রকর হিসেবে স্বপ্ন পূরণ না হওয়াতে তিনি জার্মানির মিউনিখে এসে উপস্থিত হন। তার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তার আয় রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জন্য তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। তিনি কথা বলতে ভালোবাসতেন। অল্পতেই তার বড়সড় বন্ধু মহল গড়ে উঠে। তারা আড্ডা দিতেন বীয়ার হলে। ফ্রান্সে যেমন ক্যাফে, ঠিক তেমনি জার্মানিতে বীয়ার হল। আড্ডা আলোচনায় তিনি হতেন প্রধান বক্তা। তার এমন মহনীয় ক্ষমতা ছিল যা কেউ এড়াতে পারত না। আলোচনা হত দেশ ও রাজনীতি নিয়ে। জার্মানির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য নিয়ে।


কথা ছিল যে মিউনিখে হিটলার ১৯১০ সাল পর্যন্ত থাকতে পারবেন। এরপর তাকে আবার austriaয় ফিরে যেতে হবে। কিন্তু হিটলার তা করেননি। এতে পুলিশ তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়। তারা তাকে পেয়েও যায় এবং জোর করে austriaয় ফেরত পাঠায়। হিটলারকে অবশ্য বেশিদিন বসে থাকতে হয়নি।
কারণ তখন ১৯১৪ সাল। চারিদিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের দামামা।



হিটলারের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। There is but one moment when the Goddess of Fortune wafts by, and if you don’t grab her by the hem, you won’t get a second chance.



Goddess of fortune ১৯১৪ সালেই হিটলারকে রাষ্ট্রস্বীকৃত জার্মান হবার সুযোগ করে দেয়। সুযোগটি হল ১ম বিশ্বযুদ্ধ।


হিটলার তা লুফে নিতে দেরি করেননি।